রবি ঘোষ (Robi Ghosh), বাংলা সিনেমার এক অমূল্য রত্ন, যাঁকে সাধারণত কমেডিয়ান হিসেবে পরিচিতি দেওয়া হলেও তাঁর প্রতিভা ছিল অনেক বিস্তৃত। সারা জীবন ধরে তিনি বাংলা সিনেমা জগতকে অনেক কিছু দিয়েছেন, বিশেষত তাঁর অসাধারণ কমেডি এবং অভিনয়ের দক্ষতা দিয়ে। কিন্তু রবি ঘোষের যাত্রা কমেডি এবং অভিনয়ের জগতে ছিল অপ্রত্যাশিত। ১৯৩১ সালের ২৪ নভেম্বর কোচবিহারে জন্ম নেওয়া রবি ঘোষের শৈশব কেটেছিল দুঃখ-দুর্দশা আর সংগ্রামে। ছোটবেলা থেকেই তাঁর স্বপ্ন ছিল বডিবিল্ডার হওয়ার। তাঁর শরীরচর্চা এবং সুগঠিত দেহ দেখে অনেকেই ভাবতেন, একদিন হয়তো তিনি আন্তর্জাতিক মানের বডিবিল্ডার হয়ে উঠবেন। তবে জীবন তাঁকে নিয়ে যায় অন্য পথে, যেখান থেকে তিনি হয়ে ওঠেন বাংলা ছবির কিংবদন্তী অভিনেতা।
রবি ঘোষের শৈশব এবং কৈশোর কেটেছিল ভারত-বিভাগের পর, যখন তাঁর পরিবার বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় চলে আসে। বাবা জিতেন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদার সরকারি চাকরির কারণে পরিবার নিয়ে কলকাতার মহিম হালদার স্ট্রিটে বসবাস করতেন। রবি ঘোষের পড়াশোনা শুরু হয় কোচবিহার জেনকিন্স স্কুলে এবং পরে কলকাতার ‘সাউথ সাবআর্বান মেন স্কুল’-এ ম্যাট্রিকুলেশন শেষ করেন। এই সময়েই তিনি ছিলেন উত্তম কুমারের ছোট ভাই, তরুণ চট্টোপাধ্যায়ের সহপাঠী। সেই সময়ে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি যে একদিন এই দুই বন্ধু বাংলা চলচ্চিত্রের অতি উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে উঠবে। কিন্তু রবি ঘোষের পক্ষে অভিনেতা হওয়া সহজ ছিল না। সংসারের অভাব-অনটন, তাঁর বাবার স্বপ্ন ছিল যে ছেলে একটা চাকরি পাক, আর রবি ঘোষের একমাত্র লক্ষ্য ছিল বডিবিল্ডার হওয়া। কিন্তু তাঁর অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা তাঁকে একদিন পথ দেখায়।
রবি ঘোষের অভিনয়ের যাত্রা শুরু হয় ১৯৫৩ সালে, যখন তিনি কলকাতা পুলিশের চাকরি নেন। কিন্তু ১৯৬১ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি পুরোপুরি অভিনয়ে মনোনিবেশ করেন। সেই সময় তিনি অনেক মঞ্চনাটকে অংশ নেন, বিশেষত উৎপল দত্তের পরিচালনায় “সাংবাদিক” নাটকে। অভিনয়ের প্রতি তাঁর আগ্রহ এবং দক্ষতা তাঁকে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির দিকে নিয়ে আসে। তিনি প্রথম সিনেমায় অভিনয় করেন অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের “কিছুক্ষণ” ছবিতে, যদিও এই ছবিটি বর্তমানে লুপ্ত। রবি ঘোষের শরীরচর্চার ফলস্বরূপ তাঁর শারীরিক গঠন ছিল দৃষ্টি আকর্ষণীয়, কিন্তু বাংলা সিনেমার সে সময়ে নায়ক হওয়ার জন্য যে ধরনের সুন্দর মুখ এবং রোম্যান্টিক আভা দরকার ছিল, তা ছিল না তাঁর মধ্যে। তবুও, তিনি কোনো কিছুতেই হাল ছাড়েননি। তাঁর অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা এবং চরিত্রের প্রতি আন্তরিকতা তাঁকে একজন অদ্বিতীয় অভিনেতা বানিয়ে তুলেছিল।
রবি ঘোষের অভিনয় ছিল বুদ্ধিদীপ্ত, এবং তাঁর চোখের ভাষা ছিল এমন এক বিশেষত্ব, যা তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তুলেছিল। তাঁর একেকটি মুখাবয়ব, হাসি, কিংবা চোখের ইশারা ছিল পরিপূর্ণভাবে ব্যক্তিগত, যা কোনো কৃত্রিমতা ছাড়াই দর্শকদের কাছে পৌঁছত। সেই সময়ের হিরোদের সঙ্গে তুলনা করলে রবি ঘোষের শরীর ছিল অনেক বেশি সুগঠিত, কিন্তু সেরা অভিনেতা হিসেবে তাঁকে ধরা হয়। বাংলা সিনেমার সেই উত্তম-সৌমিত্র-হাসন রাজার যুগে তিনি রোমান্টিক নায়ক হয়ে উঠতে পারেননি, কিন্তু তাঁর অভিনয় দক্ষতার জন্য তিনি সব চরিত্রেই স্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁর ‘কমেডি’ ছিল শুধু হাস্যরস নয়, বরং মাঝে মাঝে তা ছিল বুদ্ধিদীপ্ত ও সমাজচিন্তার এক অনন্য মাধ্যম।
আরও পড়ুনঃ মেহেন্দির মু’খোশ টেনে ছিঁ’ড়লো জগদ্ধাত্রী! বিরাট সিদ্ধান্ত নিয়ে ফের রহস্য উদ্ঘাটনে জ্যাস
আজও রবি ঘোষের স্মৃতি জীবিত, যদিও তাঁর জীবনযাত্রা কখনও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি। তবুও, তিনি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন, তা হল দর্শকদের মন। একসময়ের সেই কিংবদন্তী অভিনেতা আজও বাংলা সিনেমার ইতিহাসে চিরকাল অমলিন থাকবেন। তাঁর অভিনয়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রতিদিন বেড়ে চলছে, এবং দর্শকরা কখনও ভুলবেন না যে রবি ঘোষ শুধু কমেডিয়ান ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক কাল্পনিক চরিত্রের জীবন্ত রূপ।