এই মুহুর্তে বাংলা সংগীত জগতের এক বিশেষ নাম ‘সোমলতা আচার্য’ (Somlata Acharyya)। তাঁর গানের সুরে মিশে থাকে অনুভূতির গভীরতা আর এক অনন্য শক্তি। ‘মায়াবন বিহারিনী’র মতো রবীন্দ্র সংগীত হোক বা তাঁর নিজের সৃষ্টি— প্রতিটি গানে তিনি যেন এক নতুন জগৎ তৈরি করেন। আজ তিনি তরুণ প্রজন্মের কাছে যেমন প্রেরণার প্রতীক, তেমনই অনেকে তাঁকে বাংলা সংগীতের ‘রকস্টার ওম্যান’ হিসেবেও চেনেন। তবে এই উজ্জ্বল আলোর পেছনে মানুষটার অতীতে রয়েছে গভীর ক্ষত! সেই ক্ষত স্থানের চিকিৎসা তিনি নিজেই করেছেন, তবে আড়ালে। বাইরের কাউকে বুঝতে দেননি যে ভেতরে কি চলছে!
সোমলতার জীবনের সবচেয়ে কঠিন অধ্যায় শুরু হয় ২০১৮ সালের এপ্রিলে। একটি বড় কনসার্টে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। ট্রেনে ওঠার পথে সামনে পড়ে একটি হাসপাতাল— সেখানে মৃ’ত্যুর সঙ্গে লড়ছেন তাঁর বাবা। তবু পেশার টানে পেছনে ফিরে তাকাতে পারেননি। তবে, মনের মধ্যে একটা আওয়াজ শুনতে পেয়েছি যে, হয়তো এটাই শেষবার যখন বাবাকে এত কাছ থেকে পাচ্ছেন তিনি। ঠিক হলোও তাই, ট্রেন থেকে নামতেই একটা ফোন। বলা হলো বাবা না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছেন।
অন্য কেউ হলে নিশ্চয়ই সবকিছু ফেলে রেখে ফিরে আসত, শেষ একবার বাবাকে দেখার জন্য। কিন্তু সোমলতা সেটা করেননি। তাঁর কথায়, “আমরা এমন এক পেশায় আছি যেখানে ছুটি নেওয়া মানে দায়িত্ব এড়ানো। আমি জানতাম, যদি ফিরে যাই, বাবা খুশি হতেন না। নব্বই মিনিটের শো ছিল, সকাল থেকে প্রস্তুতি এরপর স্টেজে উঠলাম মুখে একটা চওড়া হাসি নব্বই মিনিটের বেশি বৈ কম সময় গান করিনি।” কিন্তু জীবনের আঘাত এখানেই শেষ হয়নি। ২০২০ সালে, যখন গোটা বিশ্ব লকডাউনের আতঙ্কে জড়িয়ে আছে, তখনই শুরু হয় তাঁর জীবনের আরেক লড়াই।
হঠাৎ মায়ের তীব্র মাথা যন্ত্রণা, চিকিৎসকের নির্ণয়— এক দুরারোগ্য ব্যাধি, যার পরিণতি প্রায় নিশ্চিত মৃ’ত্যু। হাতে সময় মাত্র এক বছর। তবু মা বা মেয়ে কেউই ভেঙে পড়েননি। সোমলতা নিজের মতো করে মায়ের যত্ন নিয়েছেন, গানের জগতে থেকেও প্রতিদিন লড়েছেন জীবনের সঙ্গে। একটি টেলিভিশন চ্যানেলের পুজো অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু সেই শুটিংয়ের আগের রাতেই মায়ের জ্বর বাড়ে, অবস্থা আশঙ্কাজনক। পেশাদারিত্বের টানে তিনি শুটিংয়ে যান ঠিকই, কিন্তু শুটিং শুরুর আগেই আসে সেই দুঃসংবাদ— মা নেই।
আরও পড়ুনঃ “বন্ধু বলেছিল, ‘হ’ট পাপিয়া’ তখন অপ্রস্তুত হলেও এখন গর্বে বুক ফুলে ওঠে!” “মা পারফেকশন চায়, সেটাই আমাদের শেখায়!”— অভিনেত্রী পাপিয়া অধিকারী, মেয়েদের চোখে আজও অনুপ্রেরণা! ‘বিবি পায়রা’-র কন্যারা আজ কতটা প্রতিষ্ঠিত জানেন?
তবুও নিজের দায়িত্বের জায়গা থেকে তিনি হাসি মুখে সেটে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন, যদিও শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ তাঁকে বাড়ি ফেরার অনুমতি দেয়। সেপ্টেম্বরেই মাকে হারান তিনি। আজও কখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে থমকে যান সোমলতা। মনে পড়ে যায় মা-বাবার মুখ, তাঁদের কথা। তবে তাঁর বিশ্বাস, “মা-বাবা যেখানেই থাকুন, তাঁরা সবসময় আমাদের সঙ্গেই আছেন। তাই এমন কোনও কাজ আমি করব না যেটাতে তারা কষ্ট পাবেন। বরং এমন কিছু করতে চাই, যাতে আজও তারা গর্ব করেন।” জীবনের দু’টি সবচেয়ে বড় ক্ষতি তাঁকে ভেঙে দেয়নি— বরং আরও দৃঢ় করেছে। সেই দৃঢ়তাই আজ তাঁর সুরের মূলে, যা শুনে মানুষ খুঁজে পায় আশার আলো আর এক অদম্য শক্তির গল্প।
