দীর্ঘ রোগভোগের পর ২০২২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি প্রয়াত হন ‘গীতশ্রী’ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। যদিও তিনি এখনও বাঙালির স্মৃতিতে তিনি উজ্জ্বল হয়ে রয়েছেন। কারণ বাঙালির কাছে ‘সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়’ নামটি আবেগের। অথচ সেই আবেগেই জোরদার ধাক্কা লাগল! মৃত্যুর পর মাত্র দেড় বছরের মধ্যেই ধূলিসাৎ হয়ে গেল তাঁর সমস্ত স্মৃতি। ভেঙে দেওয়া হল তাঁর শখের বাড়ি। দক্ষিণ কলকাতার লেক গার্ডেন্সের পোস্ট অফিসের গলিতে ঢুকলেই চোখে পড়ত সেই বাড়ি। এখন সেখানে গেলেই চোখে পড়বে অর্ধভঙ্গ সেই বাড়ি।
পোশাকি ঠিকানা-ডি/৬১৩। সকাল হলেই সেই গ্রিল দেওয়া দোতলা বাড়ি থেকে বছর দু’এক আগেও ভেসে আসত সুর। বাড়ির বাইরের মাইলফলকে লেখা থাকত- ‘এস.গুপ্ত’। কিন্তু এখন তা আর নেই, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতি বিজরিত সেই বাড়ি এখন শুধুই ধ্বংসস্তূপ। এখন গানের পরিবর্তে সেখানে শোনা যাচ্ছে হাস্তে, হাতুরির শব্দ। ফলে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের শেষ স্মৃতিটুকু মুছে যাওয়াতে আবেগে ভেসে যাচ্ছেন তাঁর অনুরাগীরা। হাতুড়ির আঘাতে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সুরের বাঁধনে মজবুত করে গাঁথা সেই বাড়ির ইট-কাঠ-পাথর। সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে পড়ে থাকবে তাঁর বর্ণময় সঙ্গীতজীবনের টুকরো ঝলক।
হেমন্ত-মান্না-শ্যামলের পাশাপাশি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠ আজও প্লে লিস্টে জ্বলজ্বল করে। ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’, ‘কে তুমি আমারে ডাকো’র মতো গানে মজে রয়েছে নয়া প্রজন্মও। তাই সেই মানুষটির স্মৃতির স্মারক এভাবে মৃত্যুর রেশ কাটতে না কাটতেই বিলীন হয়ে যাওয়ার কথা শুনে বিষাদগ্রস্ত বাঙালি। এই বাড়ি আসলে ছিল গীতশ্রী-র স্বামী, সুরকার-গীতিকার শ্যামল গুপ্তর। তাঁদের দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনের সাক্ষী ছিল এই বাড়ি। সেখানেই উঁকি দিচ্ছে পুরোনো ছবির ফ্রেম, কোথাও পড়ে রয়েছে বড়ে গুলাম আলি খানের ছবি। যাঁকে ভগবানের আসনে স্থান দিয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।
সন্ধ্যা-অনুরাগীরা ভেবেছিলেন শিল্পীর মৃত্যুর পর হয়ত তাঁর সেই বাড়ি সংরক্ষণ করা হবে, নতুন প্রজন্ম ছুঁয়ে দেখার সুযোগ পাবে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কর্মকাণ্ডকে। কিন্তু তা না হয়ে শোনা যাচ্ছে, প্রোমোটিং হবে সেখানে। গড়ে উঠবে বহুতল। যে বাড়িতে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন, সেই বাড়ির করুণ দশা দেখে চোখ ছলছল করছিল ভক্তদের। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের একমাত্র কন্যা সৌমী। তিনি নিজেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রোমোটারদের বিক্রি করে দিয়েছেন তাঁর বাবা-মা’র স্মৃতি বিজরিত বাড়ি। তাই এ নিয়ে বিতর্কের খুব বেশি অবকাশ থাকে না।
কিন্তু কেন এত দ্রুত সন্ধ্যা মুখোপাধ্য়ায়ের বাড়ি বিক্রি করে দিলেন সৌমী? প্রশ্ন অনেকেরই। কোনও সদুত্তোর মেলেনি। সন্ধ্য়া-কন্য়ার উপর ক্ষুব্ধ অনুরাগীরা। মুখ্য়মন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। লেক গার্ডেন্সের এই বাড়ির কাছেই বাস একাধিক নেতা-মন্ত্রী থেকে টলিউডের নামীদামী তারকার। কেউই নাকি জানতেই পারেননি ভাঙা পড়তে চলেছে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি। বাড়ি বিক্রি করাটা একান্তভাবেই সন্ধ্যা-কন্যার ব্য়ক্তিগত সিদ্ধান্ত। তবুও মন মানছে না সন্ধ্যা-ভক্তদের। মানুষ চলে গেলে বোধহয় তাঁর স্মৃতিরও কোনও দাম থাকে না? প্রশ্ন এখন এটাই।