জয়েন গ্রুপ

বাংলা সিরিয়াল

এই মুহূর্তে

দুঃসংবাদ! “আমি বাংলায় গান গাই”এর স্রষ্টা আর নেই! প্রয়াত প্রতুল মুখোপাধ্যায়, রইল তাঁর অমর সুর!

প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণ যেন এক যুগের অবসান। ৮২ বছর বয়সে তাঁর চলে যাওয়া মনে করিয়ে দেয় একসময় টেলিভিশনের পর্দায় দেখা সেই উজ্জ্বল মুহূর্তগুলো, যখন এক ভদ্রলোক শুধুমাত্র কণ্ঠ দিয়ে নয়, গোটা শরীর দিয়ে গাইতেন। তাঁর গানে কোনও যন্ত্রানুষঙ্গ ছিল না, তবু কিছুই ফাঁকা মনে হতো না। ছোটবেলায় টিভিতে দেখা সেই দৃশ্যের কথা স্পষ্ট মনে পড়ে—কী অদ্ভুত এক বিভা ছড়িয়ে যাচ্ছিল তাঁর সুরের মধ্যে দিয়ে! তখনও জানা ছিল না, এই মানুষটির নাম প্রতুল মুখোপাধ্যায়। আজ তাঁর প্রয়াণের সংবাদ যেন আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেই বিস্ময়ের মুহূর্তে। এমন এক সময়, যখন বাংলা ভাষার প্রতি টান ধীরে ধীরে কমছে, তাঁর বিদায় যেন আরও গভীর এক শূন্যতা তৈরি করছে।

গত শতকের আশির দশকেই বাংলা গানে নতুন এক ধারা এনেছিলেন প্রতুল। কোনও প্রথাগত সংগীতশিক্ষা ছিল না, তবু তাঁর গলায় এক নিজস্বতা ছিল, যা অন্যরকম করে তুলত তাঁর গানকে। তাঁর কণ্ঠস্বর তুলনায় সরু, রিনরিনে, কিন্তু মডিউলেশনের আশ্চর্য দক্ষতা দিয়ে তিনি তৈরি করতেন এক অনন্য পরিবেশ। বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই শুধু গলার ওঠানামায় এক অদ্ভুত সুরের আবহ গড়ে তুলতেন। সুমন চট্টোপাধ্যায় যখন নব্বইয়ের দশকে “তোমাকে চাই” গাইলেন, বাংলা গানের শ্রোতারা যেন নতুন এক ধারার সন্ধান পেলেন। কিন্তু তার আগেই প্রতুলের গান ক্যাসেটে বন্দি হয়ে পৌঁছে গিয়েছিল মানুষের কাছে। তিনিও হয়ে উঠেছিলেন আধুনিক বাংলা গানের এক গুরুত্বপূর্ণ স্বর, যিনি গানকে শুধুমাত্র বিনোদন হিসেবে দেখেননি, বরং এক আন্দোলনের মাধ্যম করে তুলেছিলেন।

প্রতুল মুখোপাধ্যায় কেবল শিল্পী ছিলেন না, ছিলেন এক দর্শনের ধারক। তাঁর লেখা “আনমনে গান মনে” রচনায় তিনি বলেছিলেন, “একটা গান ‘হয়ে উঠেছে’ কিনা সেটা অনুভব করা যায়।” তিনি বিশ্বাস করতেন, গানকে কেবল সুর বা কথার মধ্যে আটকে রাখা যায় না, তার পরিবেশনাই তাকে শ্রোতার হৃদয়ে পৌঁছে দেয়। একবার তিনি লিখেছিলেন, “পরিবেশন বা প্রেজেন্টেশন আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। এটার অভাবে অনেক মহান শিল্পসৃষ্টি মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।” তাঁর নিজস্ব পরিবেশনা, কণ্ঠের মডিউলেশন ও শরীরী ভাষার সংযোগে তৈরি হতো এক অনন্য স্থাপত্য, যা বাংলা গানের ইতিহাসে বিরল।

বাংলা গণসঙ্গীতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠ ছিলেন তিনি। “চ্যাপলিন” বা “গঙ্গা”র মতো গান তাঁর সৃষ্টিশীলতার নিদর্শন, কিন্তু তাঁর সবচেয়ে স্মরণীয় সৃষ্টি নিঃসন্দেহে “আমি বাংলায় গান গাই”। এই গান বাংলার ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা ও আত্মপরিচয়ের সঙ্গে এমনভাবে মিশে আছে যে, এটি কেবল একটি সঙ্গীত নয়, বরং একটি চেতনা। এমন অনেক শ্রোতা আছেন, যাঁরা হয়তো প্রতুলের নাম জানেন না, কিন্তু এই গানটি শুনেছেন। এটি যেন বাংলা মাটির এক অন্তরঙ্গ আর্তি, যা যুগ যুগ ধরে মানুষের মনে রয়ে যাবে।

প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গান কেবল সময়ের মধ্যে আবদ্ধ ছিল না, তা চিরকালীন। যতদিন বাংলা ভাষার অস্তিত্ব থাকবে, যতদিন বাংলার আকাশে জ্যোৎস্না পড়বে, এই গানও ছড়িয়ে পড়বে মানুষের হৃদয়ে। মহীনের ঘোড়াগুলির মতো, এই গানও ঘাস খাবে বাংলার মাঠে, বাংলার বাতাসে। কবি আবীর সিংহর সেই লাইনটি মনে পড়ে—”যতদূর জ্যোৎস্না পড়েছে সবাই সবার আত্মীয়।” প্রতুলের সৃষ্টিও ঠিক তেমনই, বাংলা ভাষাকে ছুঁয়ে সবাইকে এক সুতোয় বাঁধতে পারার ক্ষমতা রাখে। তাঁর শারীরিক প্রস্থান হলেও তাঁর গান থেকে যাবে চিরকাল।

Piya Chanda