বাঙালি মানেই সিনেমাপ্রেমী আর বাংলার সিনেমার জপগতের অন্যতম আইকন নিঃসন্দেহে সত্যজিৎ রায় (Satyajit Roy)। আর সত্যজিৎ রায় বলতেই আমাদের মাথায় প্রথম যে চলচ্চিত্রটি ভেসে ওঠে তাঁর নাম পথের পাঁচালি। সিনেমাটি তৈরি হতে সময় লেগেছিল প্রায় আড়াই বছর। তখনও তিনি কাজ করতেন বিজ্ঞাপন সংস্থায়। তাই বেশিরভাগ সময়েই সিনেমার শুটিং হত ছুটির দিনে বা অফিস থেকে ছুটি নিয়ে। সঙ্গে ছিল অর্থাভাব। জীবনবীমার টাকা, আর্টবুক বিক্রি এবং আত্মীয়স্বজনদের থেকে ধার নিয়েই চলত শুটিং। অর্থাভাবে প্রায়ই বন্ধ থাকত কাজ। টাকার জোগাড় হলে পুনরায় শুরু হত শুটিং। আজ তাঁর ৩২তম প্রয়াণ দিবসে রইল তাঁর প্রথম সিনেমার অন্তরালের কিছু কাহিনী।
বিলেত থেকে ফেরার পথেই তিনি লিখেছিলেন পথের পাঁচালির চিত্রনাট্য। সিনেমা বানানোর জন্য সিদ্ধান্ত ততদিনে নিয়ে ফেলেছেন তিনি। শিল্প নির্দেশক বংশীর সঙ্গে ছুটির দিনে বেরিয়ে পড়তেন লোকেশনের খোঁজে। গ্রামের প্রকৃতি, জীবনযাপনের নেশায় তখন বুঁদ হয়েছিলেন সত্যজিৎ। নতুন নতুন লোক যুক্ত হল টিমে। তবে তখন তিনি সন্ধান পাননি অপু এবং দুর্গার। দেওয়া হয়েছে বিজ্ঞাপন, নেওয়া হয়েছে ইন্টারভিউ। তবে মনে ধরেনি কেউই। একদিন বিকেলে বাড়ির জানালা দিয়ে তিনি শুনতে পেলেন শিশুদের কোলাহল।
আরও পড়ুনঃ সিডি বয়ের আইবুড়োভাত নাকি! আদৃত-কৌশাম্বীর বিয়ের আগে নস্টালজিয়া উস্কে এক ফ্রেমে গোটা মোদক পরিবার! সবার সঙ্গে খারাপ সম্পর্কের জেরে বাদ মিঠাই!
একটি ফুটফুটে বছর পাঁচেকের ছেলেকে ভারি মনে ধরে সত্যজিতের স্ত্রী বিজয়ার। পরিচারিকার সাহায্য খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন ছেলেটি বাঙালি। অফিস থেকে বাড়ি ফিরতেন বিজয়া সত্যজিতকে জানায় হদিশ মিলেছে অপুর। সুবীর ব্যানার্জীকে (ছেলেটির নাম) দেখে তৃপ্তির হাসে এঁকে যায় সত্যজিৎ রায়ের মুখে। আর দুর্গার চরিত্রে নির্বাচিত হন উমা দাশগুপ্ত। কলকাতার থেকে ৭০ মাইল দূরে বর্ধমানের পালসিট অঞ্চলের রেললাইনের ধারে কাশবন। সেখানেই তোলা হয় অপু দুর্গার সেই বিখ্যাত দৃশ্যের শুটিং। বড় দৃশ্য ফলে সময় লাগবে দুই দিন।
প্রথম দৃশ্যের শুটিং সেরে পরের ছুটিতে এসেই তারা দেখে কাশবন উধাও। সাধারণ লোকেরা জানায় কাশফুল গরুর খাদ্য, তাই তারা এসেই সাফ করেছে পুরো কাশবন। ফলে অগত্যা বাধ্য হয়েই তাদের অপেক্ষা করতে হয় পরের শরৎকাল পর্যন্ত। ট্রেনের শুটিংয়ের জন্যও ব্যবহার করা হয়েছিল তিনটে ট্রেন। পথের পাঁচালি সিনেমার টিমের সদস্য অনিল বাবু থাকতেন স্টেশনের কাছে। ট্রেন আসলেই তিনি বসে যেতেন ড্রাইভারের পাশে। স্পটের কাছে এলেই বয়লার কয়লা দিতে হত ধোঁ’য়ার জন্য। সাদা কাশফুলের মধ্যে কালো ধোঁয়ার নেপথ্যে রয়েছে এই কাহিনী।
অপু-দুর্গার কুকুরের দৃশ্যে গ্রামের থেকে জোগাড় করা হয় একটি কালো কুকুরকে। তবে দৃশ্য শেষ হওয়ার আগেই ফুরিয়ে যায় দিন এবং অর্থ। ৬ মাস পরে শুটিং শুরু হলে জানা যায় মারা গেছে সেই কুকুরটি। ফলেই একই রকম দেখতে আরেকটি কুকুর নিয়ে শেষ হয় দৃশ্য। অর্থের অভাবে সিনেমায় চিনিবাস ময়রার দৃশ্যের শুটিং একবারেই পুরো করতে পারেননি সত্যজিৎ। পরে অর্থ জোগাড় করে শুটিং শুরু করার পর তিনি জানতে পারেন চিনিবাসের ভূমিকায় অভিনয়কারী অভিনেতা প্রয়াত হয়েছেন। ফলেই একই রকম দেখতে আরেকজন মানুষকে নিয়ে এসে শুটিং সম্পূর্ণ করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। যার উল্লেখ পাওয়া যায় তাঁর লেখা “একেই বলে শুটিং’ বইটিতে।
আরও পড়ুনঃ জি বাংলায় দারুন খবর! ফের ছোটপর্দা কাঁপাতে ফিরছেন সবার প্রিয় মেয়েবেলার ডোডো দা! নায়িকা চরিত্রে বিরাট চমক!
সিনেমায় দেখানো অপু-দুর্গার বাড়িটিকে সত্যজিৎ রায় পেয়েছিলেন জীর্ণ জংলা অবস্থায়। সেটাকে মেরামত করতে সময় লেগেছিল একমাস। পরপর সাঁর বাঁধা একটি ঘরে সাউন্ডের যন্ত্রপাতি নিয়ে বসতেন ভূপেন বাবু। একদিন ঘর থেকে তাঁর আওয়াজ না পাওয়ার কারণে ঘরে গিয়ে সত্যজিৎ রায় দেখেন ঘরে মেঝেতে রয়েছে একটি বড় গোখরো সাপ। তাঁকে দেখেই কথা বন্ধ হয়ে গেছিল ভূপেন বাবুর। যদিও তারা মারতে পারেননি সাপটাকে। কারণ গ্রামের লোকেরা বলেছিল এটা বাস্ত্তসাপ। ফলে সাপের ভয় নিয়েই শেষ করেছিলেন তারা শুটিং।